মালয়েশিয়ার সাবাহর ১৭তম রাজ্য নির্বাচন এবার স্পষ্ট করে দিয়েছে—স্থানীয় নেতৃত্ব, আঞ্চলিক পরিচয় ও সাবাহর নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থই ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বড় বিষয়। জাতিগত বৈচিত্র্য, সীমান্ত রাজনীতি, সম্পদ বণ্টন ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ–আকাঙ্ক্ষা মিলেমিশে যে জনমত তৈরি হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বিপুল সাফল্য এনে দিয়েছে সাবাহভিত্তিক দল জিআরএস–কে।
দেশটির জাতীয় সংবাদ সংস্থা বারনামা সহ প্রায় সবকটি গণমাধ্যম জানিয়েছে, নির্বাচনী ফল অনুযায়ী, মোট ৭৩টি আসনের মধ্যে ২৯টিরও বেশি আসনে জয়ী হয়ে রাজনীতির প্রধান শক্তি হিসেবে নিজ অবস্থান আরও মজবুত করেছে জিআরএস। এর সাথে মোট ভোটের সর্বোচ্চ ৩৭.৬৪ শতাংশ পেয়ে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন গাবুঙান রাকায়াত সাবাহ (জিআরএস)-এর চেয়ারম্যান হাজিজি নূর।
এদিকে আনোয়ার ইব্রাহিমের পাকাতান হারাপান (পিএইচ) প্রত্যাশার তুলনায় গতকাল অনুষ্ঠিত ১৭তম সাবাহ রাজ্য নির্বাচনে হতাশাজনক ফল পেয়েছে। আনোয়ার ইব্রাহিম মোট ২২ জন প্রার্থী দাঁড় করালেও মাত্র একটি আসন জিততে পেরেছে তার দলটি। দেশটির গণমাধ্যমসূত্রগুলো বলছে, তবুও এই একমাত্র জয়টি এসেছে গাবুঙ্গান রাকায়াত সাবাহ (জিআরএস) থেকে এনে দাঁড় করানো প্রার্থীর জন্য।
বারনামার তথ্য অনুযায়ী, এবারের সাবাহ নির্বাচনে গাবুঙ্গান রাকায়াত সাবাহ (জিআরএস) পেয়েছে ২৯টি আসন, ওয়ারিসান ২৫টি আসন, বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) ৬টি আসন, স্বতন্ত্র প্রার্থী ৫টি আসন, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ কিনাবালু অর্গানাইজেশন (ইউপিকেও) ৩টি আসন, স্টার সাবাহ ২টি আসন, কেসেজাহতেরান ডেমোক্র্যাটিক মাসিয়ারকাত (কেডিএম) ১টি আসন, পেরিকাতান ন্যাশনাল (পিএন) ১টি আসনে এবং পাকাতান হারাপান (পিএইচ) পেয়েছে ১টি আসন।
এদিকে পুরো নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি ছিল বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়া। মোট ভোটের আটভাগের একভাগের কম পাওয়ায় ৩৮৯ জন প্রার্থী তাদের জামানত হারিয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছেন পার্টি ইম্পিয়ান সাবাহ (পিআইএস)-এর সভাপতি মিশেল ইলোক, যিনি তেলুপিড আসনে মাত্র ২৯১ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। জিআরএস-এর দাতুক জনিবোনে কুরুম ওই আসনে ৩,৮৬৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।
দেশটির সেবাতিক আসনে রুমপুন পার্টির সভাপতি ড. ইসমাইল ইদ্রিস মাত্র ৪১ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। ওয়ারিসানের মানাহিং তিঙ্গিলানি ২,৭৯৫ ভোটে এই আসন জিতে নেন। সাবেক মন্ত্রী মোহামাদ্দিন কেতাপিও স্বাধীন প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত রক্ষা করতে ব্যর্থ হন—তিনি পেয়েছেন মাত্র ১,৬৪৪ ভোট, যেখানে ওয়ারিসানের মোহাম্মদ আবদুল করিম পেয়েছেন ৭,৩২৫ ভোট।
দলভিত্তিক হিসাবে পিআইএস সর্বোচ্চ ৭২ জন প্রার্থীর জামানত হারিয়েছে। এরপর রয়েছে স্বতন্ত্র (৬০), স্টার সাবাহ এবং মহিউদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান ন্যাশনাল—উভয় দলের ৩৬ জন প্রার্থী। এছাড়া কেডিএম-এর ৩০ জন, ওয়ারিসানের ২৩ জন, ইউপিকেও’র ১৫ জন, বিএন-এর ১২ জন এবং আনোয়ার ইব্রাহিমের পিএইচ-এর দুইজন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তুলিদ আসনে ১৪ জন প্রার্থীর মধ্যে ১১ জনই নির্ধারিত ভোটসংখ্যা অর্জন করতে না পেরে জামানত হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে দি স্টার অনলাইন।
তবে এবারের সাবাহ নির্বাচনে তুন ডা: মাহাথির মোহাম্মদের নতুন দল হিসেবে পেরিকাতান ন্যাশনাল (পিএন) পেয়েছেন ১টি মাত্র সিট।
এদিকে চাইনিজ জোট ডিএপি ভয়াবহ ধাক্কার মুখে পড়েছে—গত নির্বাচনে পাওয়া আটটি আসনের একটিও এবার ধরে রাখতে পারেনি তারা। নগরাঞ্চল ও চীনা অধ্যুষিত এলাকায় ওয়ারিসানের প্রতি বড় ভোটসুইং এবং দলীয় অভ্যন্তরীণ বিভক্তির কারণে ভোটভাগ হয়ে যাওয়াকে ডিএপির পতনের মূল কারণ হিসেবে দেখেছে গণমাধ্যমগুলো।
এছাড়া আনোয়ার ইব্রাহিমের পাকাতান হারাপান (পিএইচ)-এর সমর্থনপুষ্ট আমানাহও পূর্ব মালয়েশিয়ায় তাদের প্রথম আসন জয়ে ব্যর্থ হয়েছে, যেখানে ইসলামিক পাস প্রথমবারের মতো বোর্নিওতে আসন জিতে ইতিহাস গড়েছে। একই সময়ে পার্টি ওয়ারিসান, বিশেষ করে কোতা কিনাবালুসহ বিভিন্ন এলাকায় ভোট বৃদ্ধির মাধ্যমে শক্ত প্রত্যাবর্তনের বার্তা দিয়েছে।
অন্যদিকে বড় দলগুলোর জন্য এ নির্বাচনে সম্পূর্ণ বিপর্যয় হলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা পড়বে তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট না হলেও দেশটির গণমাধ্যমসূত্রে জানাগেছে, সাবাহর নিজস্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পরিচয় ও আঞ্চলিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে সফল প্রচারণা চালাতে না পারার ফলেই এদের পতন ঘটেছে। সার্বিকভাবে ভোটাররা এবার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন—তারা সাবাহভিত্তিক দল ও নেতৃত্বের ওপরই বেশি আস্থা রাখছেন।
মন্তব্য করুন